🔱 ভারতের ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ 🛕 — শিবের শক্তির ১২টি পূর্ণরূপ! 🕉️

ভারতের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ: মহাদেবের জ্যোতির্ময় স্বরূপের পুণ্যতীর্থ

হিন্দু সনাতন ধর্মে দেবাদিদেব মহাদেব হলেন অনাদি, অনন্ত এবং সর্বব্যাপী। তাঁর আরাধনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপ হলো জ্যোতির্লিঙ্গ। ‘জ্যোতি’ অর্থাৎ আলো এবং ‘লিঙ্গ’ অর্থাৎ চিহ্ন বা স্বরূপ। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, এই লিঙ্গগুলি স্বয়ম্ভূ, অর্থাৎ এগুলি নিজে থেকেই আবির্ভূত হয়েছে। শিব মহাপুরাণ অনুসারে, একদা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ও পালনকর্তা বিষ্ণুর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিতর্ক হলে মহাদেব এক বিশাল অগ্নিস্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হন, যার আদি বা অন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই জ্যোতির্ময় স্তম্ভেরই প্রতীক এই জ্যোতির্লিঙ্গ।

ভারতবর্ষের বুকে এই বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ শৈবতীর্থের পবিত্রতম দ্বার হিসেবে বিবেচিত হয়। আসুন, আমরা এই মহিমামণ্ডিত তীর্থগুলির মাহাত্ম্য ও অবস্থানে এক আধ্যাত্মিক পরিক্রমা করি।

১. সোমনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ, গুজরাট

অবস্থান: গুজরাটের সৌরাষ্ট্রে, আরব সাগরের তীরে প্রভাস পাটন ক্ষেত্রে এই মন্দিরটি অবস্থিত।

মাহাত্ম্য: এটি পৃথিবীর প্রথম জ্যোতির্লিঙ্গ হিসেবে পরিচিত। কিংবদন্তী অনুসারে, প্রজাপতি দক্ষের অভিশাপে চন্দ্রদেব (সোম) তাঁর সমস্ত ঔজ্জ্বল্য হারালে তিনি এখানে শিবের আরাধনা করে হারানো প্রভা ফিরে পান। চন্দ্রের নামানুসারেই মহাদেব এখানে ‘সোমনাথ’ অর্থাৎ ‘চন্দ্রের প্রভু’ নামে খ্যাত। এই মন্দির বারবার ধ্বংস ও পুনর্নির্মিত হয়ে হিন্দুধর্মের সহনশীলতা ও পুনরুত্থানের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

২. মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ

অবস্থান: অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈলম পর্বতমালার উপর, কৃষ্ণা নদীর তীরে এই পবিত্র মন্দিরটি অবস্থিত।

মাহাত্ম্য: এটিকে ‘দক্ষিণের কৈলাস’ বলা হয়। পুরাণ মতে, কার্তিকেয় পিতা-মাতার উপর রুষ্ট হয়ে ক্রৌঞ্চ পর্বতে চলে গেলে, মহাদেব ও পার্বতী তাঁর কাছে আসেন। এখানে শিব ‘অর্জুন’ এবং পার্বতী ‘মল্লিকা’ নামে অবস্থান করেন, তাই একত্রে নাম হয় ‘মল্লিকার্জুন’। এটিই একমাত্র মন্দির যেখানে জ্যোতির্লিঙ্গের পাশাপাশি শক্তিপীঠও রয়েছে।

৩. মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ

অবস্থান: মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী শহরে, শিপ্রা নদীর তীরে এই বিখ্যাত মন্দির অবস্থিত।

মাহাত্ম্য: এটিই বিশ্বের একমাত্র দক্ষিণমুখী (Dakshinamukhi) জ্যোতির্লিঙ্গ, যা মহাদেবকে ‘কালের অধিপতি’ বা ‘মহাকাল’ রূপে প্রতিষ্ঠা করে। এখানকার ‘ভস্ম আরতি’ বিশ্ববিখ্যাত, যেখানে সদ্যমৃতের চিতাভস্ম দিয়ে মহাদেবের শৃঙ্গার করা হয়, যা জীবন-মৃত্যুর চক্রের প্রতীক।

৪. ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ

অবস্থান: মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া জেলায়, নর্মদা নদীর মাঝে মান্ধাতা বা শিবপুরী নামক দ্বীপে এই মন্দিরটি অবস্থিত।

মাহাত্ম্য: এই দ্বীপটির আকৃতি অনেকটা দেবনাগরী ‘ॐ’ (ওম) অক্ষরের মতো, তাই এখানকার জ্যোতির্লিঙ্গের নাম ওঙ্কারেশ্বর। এখানে জ্যোতির্লিঙ্গ দুটি ভাগে বিভক্ত – ওঙ্কারেশ্বর ও মামলেশ্বর, কিন্তু উভয়কেই একই জ্যোতির্লিঙ্গের অংশ হিসেবে পূজা করা হয়।

৫. ভীমশঙ্কর জ্যোতির্লিঙ্গ, মহারাষ্ট্র

অবস্থান: মহারাষ্ট্রের পুনে থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার দূরে সহ্যাদ্রি পর্বতমালার কোলে এই মন্দিরটি অবস্থিত।

মাহাত্ম্য: এই স্থান থেকেই ভীমা নদীর উৎপত্তি। পুরাণ অনুসারে, কুম্ভকর্ণের পুত্র রাক্ষস ভীমাসুরকে বধ করে দেবতাদের রক্ষা করার জন্য মহাদেব এখানে আবির্ভূত হন। তাঁর শরীরের ঘাম থেকে সৃষ্ট নদীই ভীমা নদী নামে পরিচিত।

৬. কাশী বিশ্বনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ

অবস্থান: উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে, পবিত্র গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে মণিকর্ণিকা ঘাটের কাছে এই স্বর্ণমণ্ডিত মন্দিরটি অবস্থিত।

মাহাত্ম্য: কাশী হিন্দুদের পবিত্রতম নগরী। বিশ্বাস করা হয়, এই নগরী মহাদেবের ত্রিশূলের উপর অবস্থিত এবং মহাপ্রলয়ের সময়েও এর বিনাশ হয় না। এখানকার অধিষ্ঠাতা দেবাদিদেব বিশ্বনাথ বা বিশ্বেশ্বর নামে পূজিত, যিনি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের নাথ। বলা হয়, এখানে মৃত্যু হলে জীব মোক্ষলাভ করে।

৭. ত্র্যম্বকেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, মহারাষ্ট্র

অবস্থান: মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার ত্র্যম্বক শহরে, গোদাবরী নদীর উৎপত্তিস্থলের কাছে এই মন্দিরটি অবস্থিত।

মাহাত্ম্য: এই জ্যোতির্লিঙ্গের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি তিনটি ছোট ছোট লিঙ্গের সমষ্টি, যা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের প্রতীক। ঋষি গৌতমের প্রার্থনায় মহাদেব এখানে আবির্ভূত হন এবং গোদাবরী নদীকে মুক্তি দেন।

৮. বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ, ঝাড়খণ্ড

অবস্থান: ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে এই পবিত্র ধাম অবস্থিত। একে বৈদ্যনাথ ধাম বা বাবা ধামও বলা হয়।

মাহাত্ম্য: কিংবদন্তী অনুসারে, লंकाপতি রাবণ কৈলাস থেকে শিবকে লঙ্কায় নিয়ে যাওয়ার বর লাভ করেন। কিন্তু শর্ত ছিল, পথে কোথাও লিঙ্গ মাটিতে রাখা যাবে না। দেবতারা ছল করে রাবণকে দিয়ে এই স্থানেই লিঙ্গটি রাখিয়ে দেন এবং সেটি সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। যেহেতু মহাদেব এখানে চিকিৎসকের (বৈদ্য) মতো ভক্তদের সকল রোগ-দুঃখ হরণ করেন, তাই তিনি ‘বৈদ্যনাথ’ নামে পরিচিত।

৯. নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, গুজরাট

অবস্থান: গুজরাটের দ্বারকা নগরীর উপকণ্ঠে এই জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরটি অবস্থিত।

মাহাত্ম্য: মহাদেব এখানে ‘নাগেশ্বর’ অর্থাৎ সর্পদের ঈশ্বর রূপে পূজিত হন। পুরাণ মতে, দারুক নামক এক রাক্ষসের হাত থেকে তাঁর ভক্ত সুপ্রিয়কে রক্ষা করতে শিব এখানে জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হন। বিশ্বাস করা হয়, নাগেশ্বরের দর্শন ভক্তকে সমস্ত প্রকার বিষ ও জাগতিক পাপ থেকে মুক্ত করে।

১০. কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ, উত্তরাখণ্ড

অবস্থান: উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল হিমালয়ের কোলে, মন্দাকিনী নদীর তীরে অবস্থিত এই মন্দির হিন্দুদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান।

মাহাত্ম্য: মহাভারতের যুদ্ধের পর পাণ্ডবরা ভ্রাতৃহত্যার পাপ থেকে মুক্তি পেতে মহাদেবের দর্শনপ্রার্থী হন। শিব তাঁদের এড়িয়ে চলার জন্য বৃষ বা ষাঁড়ের রূপ ধারণ করেন। ভীম সেই ষাঁড়কে ধরতে গেলে তার পৃষ্ঠদেশ বা কুঁজটি এখানে শিলা রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, যা কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে পূজিত হয়। প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য এই মন্দির বছরে মাত্র ছয় মাস খোলা থাকে।

১১. রামেশ্বরম জ্যোতির্লিঙ্গ, তামিলনাড়ু

অবস্থান: তামিলনাড়ুর রামনাথস্বামী মন্দির নামে পরিচিত এই জ্যোতির্লিঙ্গটি রামেশ্বরম দ্বীপে অবস্থিত।

মাহাত্ম্য: এটি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে দক্ষিণতম। লঙ্কা বিজয়ের আগে শ্রীরামচন্দ্র এখানে শিবলিঙ্গ স্থাপন করে মহাদেবের পূজা করেছিলেন। তাই এই জ্যোতির্লিঙ্গ ‘রামেশ্বরম’ অর্থাৎ ‘রামের ঈশ্বর’ নামে খ্যাত। এটি শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের এক মহামিলন ক্ষেত্র।

১২. ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, মহারাষ্ট্র

অবস্থান: মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ (বর্তমান ছত্রপতি সম্ভাজি নগর) শহরের কাছে, বিশ্ববিখ্যাত ইলোরা গুহার সন্নিকটে এই মন্দিরটি অবস্থিত।

মাহাত্ম্য: এটি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে সর্বশেষ। ঘৃষ্ণা বা কুসুমা নামে এক শিবভক্ত নারীর গভীর ভক্তির কারণে মহাদেব এখানে জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে প্রকট হন। তাঁর নামানুসারেই এই জ্যোতির্লিঙ্গের নাম হয় ‘ঘৃষ্ণেশ্বর’।

এই দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের দর্শন প্রতিটি হিন্দুর কাছে এক পরম আধ্যাত্মিক প্রাপ্তি। এই তীর্থযাত্রা কেবল ভৌগোলিক ভ্রমণ নয়, বরং নিজের অন্তরের ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার এক ঐশ্বরিক পথ।

'ওম নমঃ শিবায়'

আপনি এই পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গগুলির মধ্যে কোনটি দর্শন করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন, তা কমেন্টে আমাদের জানাতে পারেন!